আখ বা ইক্ষুর খোসা ছাড়ানো একটু কষ্টকর বলে অনেকেই আখের রসটাই পান করতে অভ্যস্ত। যদিও পথে ঘাটে বিক্রীত আখের রসের চাইতে আখ খোসা ছাড়িয়ে খাওয়াই ভালো, তারপরও কেউ কষ্ট করতে চান না। গরমে অন্যান্য বোতলজাত পানীয়ের চাইতে আঁখের রসটাকেই অনেকে তেষ্টা মেটানোর জন্য পান করে থাকেন। কিন্তু শুধু তেষ্টাই মেটায় না আখের রস। মাত্র ১ গ্লাস আখের রস প্রায় ৭টি মারাত্মক শারীরিক সমস্যা থেকে দূরে রাখবে। আখের রস খারাপ মাত্রার কোলেস্টেরল কমায়, ইহা শরীরকে পরিষ্কার করে, উন্নত করে মেটাবলিজম এবং জীবাণুমুক্ত করতে সাহায্য করে। লিভারের সমস্যা দূর করে:- আখের রসে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে উন্নত করে। এছাড়াও লিভারে সংক্রমণ হওয়া রক্ষা করে এবং বিলিরুবিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এই কারণে ডাক্তার জন্ডিস রোগীদের আখের রস পান করার পরামর্শ দেন। আঁখের রসে শর্করা থাকে!
১) নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ ও দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ করে:- নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ পুষ্টির ঘাটতির কারণেও হতে পারে যা আখের রস পান করার মাধ্যমে পূরণ করা যায়।
যদি আপনার দাঁত ক্ষয়ের পাশাপাশি নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধের সমস্যাও থাকে তাহলে আখের রস পান করাই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো ঘরোয়া প্রতিকার। আখের রসে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের মত খনিজ উপাদান থাকে যা দাঁতের এনামেল গঠনে সাহায্য করে। আখে উচ্চমাত্রার খনিজ থাকার কারণে এটি দাঁতের ক্ষয় এবং দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। তাই চকচকে সাদা দাঁত পেতে প্রতিদিন এক গ্লাস আখের রস পান করুন।
২) ইনস্ট্যান্ট এনার্জি বুস্টার:- যদি আপনি ডিহাইড্রেশনে ভুগে থাকেন তাহলে এক গ্লাস আখের রস পান করুন। কারণ আখের রস তাত্ক্ষণিক শক্তির সঞ্চয় ও তৃষ্ণা নিবারণের খুব ভালো উত্স। আখের রসে চিনি বা সুক্রোজ থাকে যা খুব সহজেই শরীরে শোষিত হয়। এই চিনি শরীরের হারিয়ে যাওয়া চিনির মাত্রাকে পুনরায় পূর্ণ করতে কাজে লাগে। এই রসে আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্লুকোজ। এই গ্লুকোজ মুহূর্তেই মানব দেহ রিহাইড্রেট করে চাঙা করে তোলে।
৩) নিরাপদ গর্ভধারণ নিশ্চিত করে:- আখের রস গর্ভবতী নারীদের খাদ্য তালিকায় যুক্ত করলে উপকার লাভ করা যায়। এটি গর্ভধারণে সাহায্য ও নিরাপদ গর্ভাবস্থা নিশ্চিত করে। আখের রসে প্রচুর ফলিক এসিড বা ভিটামিন বি ৯ থাকে যা স্পিনা বিফিডা এর মত জন্মগত ত্রুটি থেকে সুরক্ষা দেয়। এছাড়াও গবেষণায় জানা হয় যে, নারীর ডিম্বস্ফুটনের সমস্যা কমায় এবং গর্ভধারণের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে।
৪) লিভারের সমস্যা দূর করে:- আখের রসে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং ইমিউন সিস্টেমকে উন্নত করে। এছাড়াও লিভারে সংক্রমণ হওয়া রক্ষা করে এবং বিলিরুবিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। এই কারণে ডাক্তার জন্ডিস রোগীদের আখের রস পান করার পরামর্শ দেন। পিত্তরস জমে গেলে লিভারের কার্যকারিতা কমে যায় বলে জন্ডিস হয়। শরীরের গ্লুকোজের মাত্রা ঠিক রেখে দ্রুত রোগ নিরাময়ে সাহায্য করে আখের রস। এছাড়াও আখের রস ক্ষারীয় প্রকৃতির হওয়ায় শরীরের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা করায় সাহায্য করে। জন্ডিসে আক্রান্ত হলে প্রতিদিন দুই বেলা আখের রস পান করুন।
৫) হজম সংক্রান্ত সমস্যা প্রতিরোধ করে:- আখের রসে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম। এই পটাশিয়াম অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট হিসেবে কাজ করে যা হজমে সহায়তা করে এবং হজম সংক্রান্ত সমস্যা দূর করে।
৬) ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে:- অনেকেই ভাবতে পারেন প্রাকৃতিক চিনি সমৃদ্ধ আখের রস ডায়বেটিস রোগীদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। কিন্তু এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। আখের রসে ডায়েবেটিস চিনির চাইতেও কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স রয়েছে যা ডায়বেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর অন্যান্য যে কোন আর্টিফিশিয়াল চিনির বিপরীতে।
৭) ব্রণ দূর করে:- আখের রস ব্রণের মত ত্বকের সমস্যা দূর করতে অত্যন্ত কার্যকরী। এজন্য আখের রসের সাথে মুলতানি মাটি মিশিয়ে একটি ঘন পেস্ট তৈরি করতে হবে। এই পেস্টটি মুখে ও ঘাড়ে লাগিয়ে ২০ মিনিট রাখুন। তারপর ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ ও ঘাড় মুছে পরিষ্কার করুন। সপ্তাহে একদিন এটি ব্যবহার করুন। আখের রসে আলফা হাইড্রক্সি এসিড থাকে যা অনেকটা গ্লাইকলিক এসিডের মতোই কাজ করে। ত্বকের ছিদ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ব্রণের সৃষ্টি হয়। আখের রস ত্বককে এক্সফলিয়েট হতে সাহায্য করে এবং মরা চামড়ার জমার পরিমাণ কমায়।
৮) ক্যান্সার প্রতিরোধ করে:- জার্নাল অফ ফাইটোকেমিস্ট্রি'তে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা যায় আখের রসে বিদ্যমান ফ্লেভোনস দেহে ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধি ও ছড়ানো প্রতিরোধ করতে বিশেষভাবে কার্যকরী। আখের রসের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রোস্টেট ও স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক।
৯) ফেব্রাইল ডিজঅর্ডার নিরাময়ে:- ফেব্রাইল ডিজঅর্ডার এর সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে আখের রস। ফেব্রাইল ডিজঅর্ডার এর সমস্যায় উচ্চমাত্রার জ্বর থাকে। এর ফলে শরীরের প্রোটিন কমে যায়। আখের রস প্রোটিনের ক্ষতি পূরণে সাহায্য করে।
১০) জল শূন্যতা দূর করে:- জল শূন্যতা এই গরমে খুবই স্বাভাবিক একটি সমস্যা যা নানা রোগ বয়ে নিয়ে আসে। ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন ও ম্যাংগানিজ সমৃদ্ধ এই আখের রস ইলেক্টোলাইট ও জলর শূন্যতা দূর করতে বিশেষভাবে কার্যকরী।
৮) কিডনির সমস্যা দূর করে:- আখের রস প্রাকৃতিক অ্যাল্কালাইন যা অ্যান্টিবায়োটিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং কিডনির সুস্থতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে। এছাড়াও আঁখের রস পানের অভ্যাস বুক জ্বালা পোড়া ধরণের সমস্যা এবং মূত্র নালীর ইনফেকশন প্রতিরোধ করে।
১১) হাড় ও দাঁতের উন্নয়নে সাহায্য করে:- বাড়ন্ত শিশুরা যদি আখ চিবিয়ে রস পান করে তাহলে দাঁতের সমস্যা কম হয়। আখের রসে ক্যালসিয়াম থাকে যা দাঁত ও হাড়ের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
১২) দাঁত ও মাড়ির সমস্যা প্রতিরোধ করে:- আখের রসের প্রাকৃতিক অ্যাল্কালাইন অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে যা দাঁতের ক্ষয় বা মাড়ির ইনফেকশন প্রতিরোধে সহায়তা করে থাকে। এছাড়াও আখের রস মুখের দুর্গন্ধ দূর করতেও বিশেষভাবে সহায়ক।
১৩) কিডনির স্বাস্থ্য:- আখের রস শরীরে প্রোটিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় তাই এটি কিডনির স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। লেবুর রস, আখের রস এবং ডাবের জল একসাথে গ্রহণ করলে ইউরিন ইনফেকশন, যৌন রোগ, কিডনি এবং প্রস্টাটাইটিসের কারণে ঘটিত জ্বালাপোড়া কমাতে সাহায্য করে।
১৪) ত্বকের জন্য উপকারী:- আখের রসে আলফা হাইড্রক্সি অ্যাসিড থাকায় তা ত্বকের জন্য খুবই উপকারী। এই অ্যাসিড ব্রণ কমায়, ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়া ঠেকায় এবং ত্বকে আর্দ্রতা বজায় রাখে। মুখের ব্রণ, বলিরেখা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এটি। আখের রস যদি মুখে মাস্ক হিসেবে লাগিয়ে রাখা যায় তাহলে ত্বকের রুক্ষতা দূর হয়ে যায়। সেই সঙ্গে ত্বক হয়ে উঠে আরও বেশি উজ্জ্বল ও সতেজ।
১৫) হৃদরোগ উপশমে:- আখের রস হার্ট ভালো রাখার পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাক রুখতেও সাহায্য করে। এছাড়া শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের নিঃসরণ কমাতেও ভূমিকা রাখে এটি।
১৬) হজমশক্তি:- আখের রসে পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাসিয়াম এবং ফাইবার রয়েছে। এটি খেলে কোষ্ঠ কাঠিন্যের সমস্যা দূর হওয়ার পাশাপাশি হজম শক্তিও বেড়ে যায়।
১৭) ওজন কমায়:- আখের রসে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় তা ওজন কমাতে সাহায্য করে। এমনকি কোলেস্টেরলের পরিমাণও কমিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এটি।
১৮) ক্যান্সার প্রতিরোধে :- আখের রসে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ থাকে। যা ব্রেস্ট ক্যানসার এবং প্রস্টেড ক্যানসার রোগ প্রতিরোধে সক্ষম। এছাড়া ঠাণ্ডা-জ্বর, গলায়
ক্ষত, দাঁতের ক্ষয়রোধ প্রভৃতি সারাতে সাহায্য করে আখের রস। শুধু তাই নয়, এটি জন্ডিসে ওষুধের ভূমিকা পালন করে। কাজেই সুস্থ থাকতে নিয়মিত আখের রস পান করুন।
১৯) ক্ষত সারায়:- আখের রস নিয়মিত পান করলে শরীরের ক্ষত ভালো হয়।
২০) ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ভালো:- যদিও আখের রসে উচ্চমাত্রার চিনি আছে তবুও, এটি ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য ভালো। কেননা এতে রয়েছে প্রাকৃতিক চিনি যাতে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম, ফলে এটি ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বৃদ্ধি রোধ করে। তবে ডায়াবেটিস-২ টাইপের রোগীদের ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা করার পরে পান করা উচিত।
২১) পুষ্টির অভাব পূরণ এবং নখে আলাদা চমক:- আপনার শরীরে যদি পুষ্টির অভাব পড়ে তবে এর প্রভাব সহজেই আপনার নখের স্বাস্থ্য দেখে বুঝতে পারবেন। যদি আপনার ভঙ্গুর বর্ণহীন নখের উপর সাদা দাগ থেকে থাকে তাহলে এটি আপনার খাদ্যে তালিকায় আখের রস যোগ করার উত্কৃষ্ট সময়। নখে আলাদা চমক এনে দেয়ার সব উপাদান আছে এতে।
আখ ঘাস পরিবারেরর একটি C4 গাছ, একটি অর্থকারী ফসল, প্রথম উৎপত্তিস্থল গায়নাতে, পরে বানিজ্যিক ভাবে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। বাংলাদেশ, ভারত, দক্ষিন এশিয়া, ব্রাজিল, ল্যাট্রিন আমেরিকা প্রভৃতি দেশে প্রচুর আখ জন্মে। বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র আখ জন্মে।এদেশে বিভিন্ন প্রজাতির আখ রয়েছে। বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট আখ নিয়ে গবেষণা করে থাকে। এ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠান হতে ৩০ টির অধিক প্রজাতির আখের নতুন জাত বের হয়েছে। সর্বশেষ জাত সমুহ হচ্ছে বিএসআরআই আখ ৪১, ঈশ্বরদী ৪৩, ঈশ্বরদী ৪৪। কিছু কিছু অপেক্ষাকৃত নরম চিবিয়ে খাবার জন্য, গ্রাম বাংলার সর্বত্র ছোট বড় সবাই আখ চিবিয়ে রস খাওয়া পছন্দ করে। আখের রস উপকারী একথা সবাই বিশ্বাস করে কিন্তু এর খাদ্য মুল্য কতটা এ বিষয়টি সবার জানা নেই। সাম্প্রতিক গবেষনাতে আখের রসের পুষ্টিগুনের উপর চমৎকার তথ্য জানা গেছে।

1 মন্তব্যসমূহ
বাহ.. ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন