বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে পুরনো নমুনা ‘চর্যাপদ’। কিন্তু চর্যাপদ থেকে সেকালের নারী ও পুরুষেরা কী ধরনের পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করতেন সে সম্বন্ধে আমরা কোনো ধারণা পাই না। তবে প্রাচীন ও মধ্যযুগের যেসব ভাস্কর্য, পোড়ামাটির ফলক ও পাণ্ডুলিপির চিত্র পাওয়া যায় তা থেকে আমরা তাদের পোশাক সম্বন্ধে কিছুটা জানতে পারি। তাদের বেশিরভাগ পোশাকই ছিল লজ্জা নিবারণ ও শীত-গ্রীষ্মসহ বিভিন্ন আবহাওয়ার রুক্ষতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দরকারী ন্যূনতম পোশাক। সেজন্যই সে সময়ে নারী-পুরুষের পোশাকে খুব একটা পার্থক্য ছিল না এবং এ যুগের মানুষের মতো রকমারি পোশাকও ছিল না।
নারী ও পুরুষ উভয়ই পরতেন একটিমাত্র বস্ত্র- শাড়ি অথবা ধুতি। অভিজাত পুরুষরা হাঁটুর নীচ অব্দি ধুতি পরলেও সাধারণ পুরুষেরা অত্যন্ত খাটো ধুতি পরতেন। নারীরা শাড়ি পরতেন পায়ের কব্জি পর্যন্ত ঝুলের। নারী ও পুরুষেরা উর্ধ্বাঙ্গে অলংকার ছাড়া আর কিছু পরতেন না। উৎসবে ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অভিজাত নারীরা কখনো কখনো ওড়না ব্যবহার করতেন। সেন আমলে ধনী মহিলারা বিভিন্ন প্রসাধনী ব্যবহার করতেন। নারীরা কানে কচি তালপাতার মাকড়ি এবং কোমরে সোনার তাগা পরতেন।
ইন্দো-মুসলিম যুগে এসে মুসলমানদের প্রভাবে পোশাকে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। মধ্যযুগীয় শাসকেরা যেসব রুক্ষ অঞ্চলের পোশাক নিয়ে এসেছিলেন, এদেশে এসে তা আর পরিবর্তন করেননি। প্রথমদিকে বঙ্গে এসব পোশাক গ্রহণ করা না হলেও চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীতে এসে আস্তে আস্তে এ অঞ্চলের মানুষেরা এসব পোশাক পরতে শুরু করেন। প্রথমে বাদশাহের দরবারে, তারপর অভিজাতদের মধ্যে এবং পরে গ্রামের ধনীদের মধ্যে এসব পোশাক পরার প্রচলন শুরু হয়। প্রাচীন যুগে নারী-পুরুষ উভয়েই একপ্রস্থ কাপড় পরলেও মধ্যযুগে এসে উর্ধ্বাঙ্গে, নিম্নাঙ্গে ও মাথায়- মোট তিনটি বস্ত্র পরতে দেখা যায়। মুকুন্দরাম তাঁর ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’তে পাগড়ি পরার কথা উল্লেখ করেছেন। সেসময় এরকম মুসলমানী পোশাক দরবার ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষ এমনকি অন্য ধর্মের মানুষের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। শেখ জৈনুদ্দিনের আঁকা লেডি ইম্পের ছবিতে দেখা যায়- অভিজাতরা তো বটেই, চাকর-বাকররাও মাথায় পাগড়ি পরে আছে। যাদের এত পোশাক কেনার সামর্থ্য ছিল না তারা অবশ্য আগের মতো শুধু ধুতিই পরতেন।
মুকুন্দরামের লেখা থেকে জানা যায়, ষোল শতকের শেষ দিকের সচ্ছল মুসলমানেরা ইজার অথবা পাজামা পরতেন। মুসলমানদের প্রভাবে পরে হিন্দুদের মধ্যেও ইজার পরার প্রচলন শুরু হয়। ধর্মমঙ্গলে মুসলমানদের লম্বা জামা ও পাগড়ি পরার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ পোশাক সাধারণ মুসলমানদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাদের সাথে হিন্দুদের পোশাকের খুব একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। মুসলমানদের অনেকে ধুতির চেয়ে ছোট একখণ্ড কাপড় পরতো, যাকে এখন বলা হয় ‘লুঙ্গি’।
প্রাচীন বাঙালি সমাজে জুতা পরার কোনো রীতি ছিল না। পনাই ও পাদুকার উল্লেখ থাকলেও মধ্যযুগের বাংলায় চামড়ার জুতা পরার কথা সে যুগের কোনো সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়নি। ১৮২০ সালের দিকে আঁকা মহররমের মিছিল ও ঈদের ছবিতে সবাইকে ভালো পোশাক পরিহিত অবস্থায় দেখা গেলেও তাদের পায়ে কোনো জুতা বা পাদুকা ছিল না। এ থেকে ধারণা করা যায়, সে যুগে জুতা পরার কোনো প্রচলন ছিল না।
0 মন্তব্যসমূহ