বাজারে যদি পণ্য বিক্রি না হয়, তাহলে প্রণোদনা দিয়ে কি সেই শিল্পকে বাঁচানো যায়? আপনি বাজারে যা কিছুই কিনতে যান না কেন—কাপড়, জুতা, কসমেটিকস; দেখবেন সেটা ভারতীয় অথবা চীনা। আর যখনই দোকানি বলবেন এটা বিদেশী, তখনই ৯৫ শতাংশ ক্রেতা খুশিতে টগবগ করে উঠবেন এবং বলবেন, ঠিক আছে দিয়ে দিন। অথচ তিন ভাগের এক ভাগ টাকা দিয়ে দেশী একই পণ্য কেনা যেত। আসলে আমাদের দেশপ্রেমের অনেক অভাব রয়েছে, যদি তা না হতো তাহলে বিদেশী পণ্যে এভাবে বাজার সয়লাব হয়ে যেত না। যে দেশ ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে, সে দেশের মানুষ হয়ে আমরা দেশী পণ্য কিনতে লজ্জাবোধ করি। আমরা যদি একটা দেশী পণ্য কিনি, তাহলে সে টাকাটা কোথায় যাবে? প্রথম যাবে আমাদের দেশের মালিকের কাছে। তারপর যাবে শ্রমিকের কাছে। পণ্য যদি ভালো চলে তাহলে যেকোনো মালিক তার উৎপাদিত পণ্যের মান বৃদ্ধি করবেন সুনাম বৃদ্ধির জন্য। আর বাংলাদেশের পণ্যের মান কি এত খারাপ? এত খারাপ হলে তৈরি পোশাক রফতানিতে আমরা বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকি কী করে? আমাদের দেশের ওয়ালটন ফ্রিজ বিশ্বের অনেক দেশে চলে। আমাদের ওষুধ বিশ্বের ৭০টি দেশে রফতানি হয়। আমাদের দেশের সিমেন্ট, বাইসাইকেল, বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্যসহ অনেক কিছু বিদেশে রফতানি হয়। বিদেশীরা আমাদের পণ্য ব্যবহার করতে পারলে আমরা কেন পারব না? এবার দেখি বিদেশী পণ্য আমদানি করতে গিয়ে আমরা কত দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কয়েক বছর ধরে প্রতিনিয়ত বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। এতে অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে।



বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষে আমাদের দেশে বেচাকেনা বেশি হয়। যেমন ঈদ, পূজা-পার্বণ, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি। যেহেতু এ দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান, সে হিসাবে ঈদের সময় বেচাকেনা বেশি হয়। বাকিটা হয় পূজা-পার্বণ, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদিতে। ব্যবসা হয় কোটি কোটি টাকার। এছাড়া সারা বছর কমবেশি বেচাকেনা হয়। কিন্তু আমরা বাজারে গিয়ে কতজন দেশী পণ্য আনছি? অনেকে বলেন, দেশী পণ্যের মান ভালো না। আমি, আপনি কি একবার ভেবে দেখেছি, আমরা যদি দেশী পণ্য না কিনি, তাহলে মান ভালো হবে কীভাবে? একটা কারখানার উৎপাদিত পণ্য—কাপড়, জুতা যা-ই হোক না কেন, যদি মোটামুটি চলে, তাহলে কারখানার মালিক চিন্তা করবেন কীভাবে পণ্যটির মান বৃদ্ধি করা যায়। কিন্তু বাজারে যদি পণ্য না চলে, শ্রমিকদের বেতন দিতে না পারেন, তাহলে তিনি কীভাবে পণ্যের মান বৃদ্ধির দিকে নজর দেবেন। আপনি হয়তো বলবেন, আমি তো এ দামে আরো ভালো মানের পণ্য পাচ্ছি, তাহলে মানহীন পণ্য কিনব কেন? আপনি কি ভেবে দেখেছেন, নিয়মিত ভারত-চীনের পণ্য কিনছেন বলেই তারা পণ্যের মানের উন্নতি করতে পারছে। পণ্যের মান নিয়ে আরো একটা কথা আছে। আপনি ভারতীয় অথবা চীনা যে জুতা কিনছেন ১ হাজার ২০০ টাকা দিয়ে, একই মানের দেশী জুতা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে পাবেন, তবে বাংলাদেশের পণ্যটি চকচক একটু কম করতে পারে কিন্তু টেকসই হবে ভারতীয়-চীনার চেয়ে বেশি। আপনি, আমি যদি নিয়মিত দেশী পণ্য কিনি, তাহলে সব পণ্যের মান বাড়বে এবং সেটা হতে বেশি দিন লাগবে না। আমি এর একটা প্রমাণ দিই। যাদের বয়স ৪৫-এর উপরে, তারা দেখেছেন আশির দশকে জাপানি বলপেন ‘রেড-লিফ’ সারা দেশে দেদার চলত। রেড-লিফ বলপেন ছাড়া কোনো পরীক্ষার্থীকে এসএসসি-এইচএসসি বা কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিতে দেখা যায়নি। তারপর কিছু ব্যবসায়ী এগিয়ে এলেন, তারা ৩-৪ টাকার মধ্যে বলপেন তৈরি করতে সক্ষম হলেন। আর রেড-লিফ কলমের মূল্য ছিল ১০ টাকা। ৩ টাকা মূল্যের বলপেন ইকোনো সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। এরপর ধীরে ধীরে রেড-লিফ উঠে গেল। বাজার দখল করল দেশী কোম্পানিগুলো। বর্তমানে ম্যাটাডোরসহ বিভিন্ন ভালো কোম্পানি উন্নত মানের কলম তৈরি করছে। এটা সম্ভব হয়েছে আমরা সবাই দেশের উৎপাদিত পণ্যটি কিনেছিলাম বলে।


রফতানি আয় ধীরে ধীরে হলেও বাড়বে। উল্লেখ্য, রফতানি আয়ের তুলনায় আমদানি ব্যয় যেটুকু বেশি, তার পার্থক্যটাই বাণিজ্য ঘাটতি। আর চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আমদানি-রফতানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না, আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।

আপনি কি মনে করেন, যারা ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়েছেন, তারা সবাই খারাপ? তাদের মধ্যে অনেকেই আছেন ঋণ নিয়ে কারখানা গড়ে তুলেছিলেন লাভের আশায়। কিন্তু তার কারখানার উৎপাদিত পণ্য বিদেশী পণ্যের সঙ্গে ভীষণ মার খেয়েছে বলেই আজকে তিনি ঋণখেলাপি। তবে এ সংখ্যা ২৫-৩০ শতাংশের বেশি হবে না বলেই আমার বিশ্বাস। দেশী পণ্য কেনা, এটা কোনো ছোটখাটো ব্যাপার নয়। এটা কোনো হেলাফেলার ব্যাপার নয়। আমি মনে করি, এটা দেশের জন্য বিশাল ক্ষতিকর একটা বিষয়। আপনার যদি মেরুদণ্ড ভাঙা থাকে, তাহলে আপনি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবেন না। আর যদি দাঁড়াতে না পারেন, তাহলে আপনাকে হুইলচেয়ারে করে অন্যের সাহায্য নিয়ে চলতে হবে। অর্থনীতি হচ্ছে আমাদের দেশের মেরুদণ্ড। আমাদের দেশের মেরুদণ্ড আমরা যদি সোজা রাখতে চাই, তাহলে দেশী পণ্য ব্যবহার করাটা হচ্ছে সর্বোত্তম পন্থা। আমাদের গ্রামগঞ্জে একটা কথা আছে বিদেশী রুই থেকে দেশের পুঁটি মাছ ভালো। আসুন আমরা দেশের জন্য একটু ছাড় দিই। দোকানে গিয়ে বলি দেশী পণ্য দিতে। আমরা যখন সবাই অথবা ৮০ জন দেশী পণ্য কিনতে চাইব, তখন দোকানদারের টনক নড়বে। দেশী পণ্য রাখা শুরু করবেন দোকানদার। দেশী কারখানাগুলো সচল হতে থাকবে। আমদানি ব্যয় কমে আসবে। লাখ লাখ বেকারের কর্মসংস্থান হবে, খেলাপি ঋণ অনেক কমে যাবে। পণ্যের মান বৃদ্ধি পাবে। পণ্যের মান বৃদ্ধি পেলে রফতানি আয়ও বাড়বে। দেশী পণ্য কিনলে ধনী হবেন আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা। শ্রমিকদের বেতন বাড়বে। তাদের জীবনযাত্রার মান হবে যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য অথবা জাপানি শ্রমিকদের মতো। দেশ ধনী হলে আপনি, আমিও ধনী হব। সেই সঙ্গে বিলাস দ্রব্যসামগ্রী ও অধিক মূল্যমানের গাড়ি আমদানি নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। তাহলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে যাবে। সেই টাকা দিয়ে দেশের উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হবে। দেশ উন্নত হতে বেশি দিন লাগবে না। সবাই দেশী পণ্য ব্যবহার করলে ২০৪১ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। পরিশেষে বলব, জাপান আমাদের চেয়ে খুব বড় দেশ নয় কিন্তু জাপানের অর্থনীতি বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম। তারা রফতানি আয়ের টাকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করেছে। সবাই দেশী পণ্য ব্যবহার করলে সেদিন বেশি দূরে নয়, আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরাও বিদেশে বিনিয়োগ করবেন। আসুন সবাই দেশী পণ্য ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধকে সম্মান জানাই এবং দেশপ্রেমের পরিচয় দিই।