পৃথিবীর অনেক দেশেরই জাতীয় বৃক্ষ রয়েছে। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও জার্মানির জাতীয় বৃক্ষ হচ্ছে ওক গাছ। কানাডার ম্যাপল, ভারতের বট, পাকিস্তানের সেড্রাস ডিওডর, শ্রীলঙ্কার নাগেশ্বর, ভুটানের সাইপ্রেস, সৌদি আরব, লেবানন, আফগানিস্তান, ইতালি, নরওয়ে ও সুইডেনের খেজুরগাছ, লেবাননের সেডার এবং কিউবার জাতীয় বৃক্ষ কিউবান রয়াল পাম।
বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল, জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় মাছ ইলিশ, জাতীয় পাখি দোয়েল, জাতীয় প্রাণী রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আছে জাতীয় উদ্যানও। কিন্তু স্বাধীনতার ৩৯ বছরেও আমাদের কোনো জাতীয় বৃক্ষ ছিল না। এবার সেই অভাব ঘুচল।
তবে আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ ঘোষণার পেছনে ফল আমের অবদানই বোধ হয় বেশি। কারণ, আম খেতে ভালোবাসেন না, এমন বাঙালি পাওয়া কঠিন। ২০১০ সালে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় আমের পক্ষে যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছিললো সেগুলো হলো—আমগাছ দেশের বেশির ভাগ মানুষ চেনে। গ্রামে আমগাছ নেই, এমন বাড়িও খুঁজে পাওয়া কঠিন। কারও বাড়িতে ১০টি গাছ থাকলে অন্তত একটি আমগাছ থাকবে। ফল সুস্বাদু হওয়ার পাশাপাশি এর কাঠ ঘর ও আসবাব তৈরিতে বেশ ব্যবহূত হয়।
এর সঙ্গে মন্ত্রিসভার আলোচনায় আরও যা যোগ হয়েছেলো তা হলো—বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের অনুভূতির সঙ্গে আম ও আমগাছের সম্পর্ক আছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ব্রিটিশদের হাতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে যে বেদনার ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছিল, ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৭ এপ্রিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার শপথ নেয় এই আম্রকাননে। আমাদের জাতীয় সংগীতে আছে "ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে, ঘ্রাণে পাগল করে" এখানে আমগাছের উপস্থিতি দেশপ্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে। আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে অনুমোদন দিতে গিয়ে এসব কিছুকে বিবেচনা করা হয় তখন। তৎকালীন পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব মিহির কান্তি মজুমদার জানান আমগাছের পরিচিতি এর ফলের জনপ্রিয়তার কারণে। পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতার সঙ্গে আমবাগানের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এসব দিক বিবেচনা করে আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে প্রস্তাব ও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় ছয়টি বৃক্ষের নাম প্রস্তাব করেছিল। সেখানে আমগাছের সঙ্গে ছিল কদম, তাল, হিজল, পলাশ ও শিমুল গাছের নাম। বৈঠকে বেশির ভাগ মন্ত্রী আমগাছের পক্ষে অবস্থান নেন। ফলে সর্বসম্মতিক্রমে আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা প্রস্তাবে ছয়টি বৃক্ষের উৎপত্তি, গুণাগুণসহ বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়। কাঠের মূল্য না থাকায় ফুল গাছগুলো আলোচনার শুরুতেই বাদ পড়ে যায়। বেশির ভাগ মন্ত্রী ফল গাছকে জাতীয় বৃক্ষ করার পক্ষে মত দেন। তবে তালগাছ দেশের সব অঞ্চলে হয় না বলে এই গাছের নাম বাদ দেওয়া হয়।
জাতীয় বৃক্ষ সম্পর্কে প্রস্তাবের জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রথমে প্রধান বন সংরক্ষককে দায়িত্ব দিয়েছিল। তিনি বন অধিদপ্তরে সভা করেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতামত নিয়ে বট, গর্জন ও শালবৃক্ষের নাম প্রস্তাব করেন। পরে গত ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০১০ সালে অন্যান্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সভা করে। ওই সভায় কদম, তাল, হিজল ও পলাশের নাম প্রস্তাব হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়। পরে আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করে আম ও শিমুলের নাম যুক্ত করা হয়।
প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক সংগঠন তরুপল্লব ১৬ মে, ২০১০ সালে জাতীয় বৃক্ষ শনাক্তকরণ ও এর প্রচারণা চালানোর জন্য পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে একটি প্রস্তাব পাঠায়। জাতীয় বৃক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে তরুপল্লবের সভাপতি অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা গত রাতে তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা দীর্ঘ দিন ধরে জাতীয় বৃক্ষের অভাব বোধ করছিলাম। সে শূন্যতা আজ পূর্ণ হলো। এটা আমাদের সৌভাগ্য যে বিশ্বের অন্য কোনো দেশ আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করেনি। আমের সুখ্যাতি ও প্রয়োজনীয়তা বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশে আমের বনজ প্রজাতি রয়েছে। সে অর্থে আমরা আমের আদি মালিক। আমগাছ চিরসবুজ, সুদর্শন ও দীর্ঘজীবী। আম আমাদের সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। আমপাতা হিন্দু ও বৌদ্ধরা ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চায় বহুলভাবে ব্যবহার করে। আম আমাদের সাহিত্য ও লোকগাথায় নিবিঢ়ভাবে যুক্ত। এমন একটি গাছকে জাতীয় বৃক্ষ করা সুসিদ্ধান্ত হয়েছে। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।’
0 মন্তব্যসমূহ